
ডাঃ ফারুকুজ্জামান।। পিত্ত পাথরের চিকিৎসার একমাত্র নিরাময়যোগ্য সমাধান হলো, অপারেশনের মাধ্যমে পিত্ত পাথরসহ পিত্তথলি ফেলে দেয়া। আজ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো, পিত্তপাথরের কারণে পিত্তথলির অপারেশন। সেই সাথে আলোচনা করবো উদ্ভুত করোনা পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে কি করণীয়।
অপারেশনর ধরণ ও সময়:
Emergency cholecystomy (ইমার্জেন্সি কোলেসিস্টেকটমি):
কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর জীবন রক্ষার্থে বা অনাকাঙ্খিত জটিলতা এড়াতে, অতি জরুরি ভিত্তিতে পিত্তথলি অপারেশন করে ফেলে দেয়া প্রয়োজন পড়ে। যেমন: পিত্তথলিতে পুঁজ জমে গেলে, পিত্তথলি পঁচে গেলে বা পিত্তথলির তীব্র ইনফেকশন ইত্যাদি পরিস্থিতিতে। এক্ষেত্রে অপারেশনের ঝুঁকি বা জটিলতার সম্ভবনা তুলনামূলকভাবে বেশ বেশি । কিন্তু রোগীর জীবন রক্ষার্থে তা অতি আবশ্যক হয়ে পড়ে।
Early cholecystectomy (আর্লি কোলেসিস্টেকটমি):
এক্ষেত্রে সাধারণত Acute Calculous Cholecystitis (পিত্তথলির পিত্তপাথর জনিত ইনফ্লামেশন/ প্রদাহ)-এর ক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা করে, রোগীর সাধারণ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে (সাধারণত ৫-৭ দিনের মধ্যে) পিত্তথলির অপারেশন করা হয়।
Late/Elective cholecystectomy (লেট কোলেসিস্টেকটমি): এক্ষেত্রে পিত্তপাথর জনিত পিত্তথলির ইনফ্লামেশন/ প্রদাহ (Acute Cholecystitis) শুরু হওয়ার পর, চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সুস্থ করা হয় এবং পরবর্তীতে প্রায় ৬ সপ্তাহ পর রোগীর পিত্তপাথর অপারেশন করা হয়। এ সময়ের মধ্যে, অপারেশনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সব বিষয় গুলোকেও (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপ ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতে করে অপারেশনের ঝুঁকি কমে এবং অনেক অনাকাঙ্খিত জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়।
Routine cholecystectomy (রুটিন কোলেসিস্টেকটমিঃ দীর্ঘ মেয়াদি পিত্তপাথর জনিত পিত্তথলির প্রদাহ (Chronic Cholecystitis), উপসর্গহীন পিত্তপাথর (Asymptomatic gall stone) ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে মূল রোগের বাইরে, রোগীর যে সকল রোগ/ সমস্যা (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপ,হার্টের অসুখ ইত্যাদি) অপারেশনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, সেগুলো তুলনামুলক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে, তারপর পিত্তথলির অপারেশন করা হয় ।
পিত্তপাথর অপারেশনের পদ্ধতি সমূহ:
Open cholecystectomy (ওপেন কোলেসিস্টেকটমি): এক্ষত্রে পেট কেটে পিত্তপাথর অপারেশন করা হয় বলে, জটিলতা সম্ভবনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি । এভাবে অপারেশন পর সাধারণত ৩-৫ দিন হাসপাতালে থাকা লাগে ।
Laparoscopic Cholecystectomy (ল্যাপারোস্কোপিক কোলেসিস্টেকটমি): ল্যাপারোস্কোপিক কোলেসিস্টেকটমি বলতে, পেটের উপর তৈরী করা ছিদ্র পথে ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পিত্তপাথর সহ পিত্তথলি ফেলে দেয়াকে বোঝায় । পেট বড় করে কাটা লাগেনা বিধায়, অপারেশন পরবর্তী ব্যথা ও অন্যান্য জটিলতা কিছুটা কম হয়ে থাকে । কাটার বড় দাগ থাকে না । এভাবে অপেরেশনের পর অধিকাংশ রোগীকে (>৯০%) ২-৩ দিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া যায় ।
ল্যাপারোস্কোপিক অপেরেশনের সীমাবদ্ধতা হলো, সব ক্ষেত্রে পিত্তপাথরের অপারেশন এভাবে করা যায় না । পূর্বে পেটে করা কোনো অপারেশন (অন্য কোনো কারণে), বা পূর্বে বারবার পিত্তথলির প্রদাহ ও অন্যান্য কারণে পিত্তথলির চারপাশে শক্ত ব্যান্ড তৈরী হয়, খাদ্যনাড়ি এসে চারপাশে জড়িয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপিক অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই এই অবস্থাগুলো আগে থেকে বোঝা সম্ভবপর হয় না (ল্যাপারোস্কোপির সময় পেটের উপর তৈরী করা ছিদ্রপথে ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঢুকানোর পর বোঝা যায়)। এ ধরণের পরিস্থিতিতে, জটিলতা এড়াতে ল্যাপারোস্কোপিক অপারেশন বন্ধ করে, পেট কেটে অপারেশন করে দেয়া উত্তম।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতি এবং এ বিষয়ে করণীয়ঃ
১) যে কোনো অপেরেশনই ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো অপারেশনই (ছোট কিংবা বড়) রোগীর শরীর ও মনের উপর একটি আঘাত । অপেরেশনে রোগীকে অজ্ঞান করতে বা শরীরের অংশ বিশেষ অবশ করতে, যে সকল ঔষধপত্র ব্যবহার করা হয়, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ । তাই রোগীর শরীরে অপেরেশনের আঘাত, কিংবা অপারেশন বা অজ্ঞান বা অন্য কোনো কারণে ব্যবহৃত ঔষধপত্র, রোগীর শরীর কতখানি সহ্য করতে পারবে, তা আগাম ধারণা করা গেলেও, একেবারে নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতা ও পুথিলব্ধ জ্ঞান মতে, এই বিষয়গুলোই এক এক রোগীর শরীরে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করতে দেখা যায়। তাই জটিলতা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আগাম বলা যে কারো পক্ষে দুরূহ ।
২) বর্তমান তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে “কোনো হাসপাতালই এখন আর রোগী, চিকিৎসক কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জন্য নিরাপদ স্থান নয়।” অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালই যে কারণে তাদের সেবার পরিধি গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে । সাধারণ সেবা, ইমার্জেন্সি সেবা, এমনকি ক্যান্সার চিকিৎসাও বেঁধে ফেলতে হয়েছে সীমিত পরিসরের ছকে। লক্ষ্য একটাই, সংক্রমণ প্রতিহত করা । কারণ, সংক্রমণ ব্যাপকহারে একবার শুরু হলে, তখন তা প্রতিহত করা অত্যান্ত দুরূহ কাজ । ব্যাপকহারে প্রাণহানির সম্ভবনা প্রকট ।
৩) বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব সঙ্গত কারণেই, অপেরেশনে ইনফেকশন কিংবা অন্য কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে, তা সমন্বিতভাবে চিকিৎসা করা রোগীর অভিভাবক কিংবা চিকিৎসকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যে কারণ “The Royal College of Surgeons of England”-সহ নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন দেশি-বিদেশী মেডিকেল ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, এই অহেতুক ঝুঁকি এড়াতে ইতিমধ্যে প্রদান করেছে বিভিন্ন নীতিমালা ও নির্দেশনা।
তার কিছু সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম:
নির্দেশনার সারসংক্ষেপ:
ক) অপেরেশনকে মূলত যতখানি সম্ভব “ইমার্জেন্সি সার্জারির” মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। ইমার্জেন্সি সার্জারি বলতে সাধারণভাবে সেই সকল অপেরেশনকেই বোঝানো হয়, যা অতি জুরুরি ভিত্তিতে না করা হলে রোগীর জীবননাশের সম্ভবনা প্রায় শতভাগ। এক্ষেত্রে অপারেশন শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে, রোগীর জীবন রক্ষার্থে “উচ্চ ঝুঁকি অঙ্গীকারনামা”-এর ভিত্তিতে করা হয় । উদাহরণ দিচ্ছি- জনাব রজত আলী, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ছুরিকাহত অবস্থায় । পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলছে পেটের ভিতর খাদ্যনাড়ি সহ ছোট বড় বেশ কিছু রক্তনালিকা কেটে গেছে।
পিত্তপাথরের ক্ষেত্রে, পিত্তথলিতে পুঁজ জমে রক্তে ইনফেকশন ছড়িয়ে যাওয়া, পিত্তথলি পঁচে যাওয়া বা পিত্তথলির তীব্র ইনফেকশন ইত্যাদি ক্ষেত্রেই মূলত “ইমার্জেন্সি সার্জারির” বিবেচনায় আনা হয়।
খ) ইমার্জেন্সি অপেরেশনের সময় ও পরিসর যথাসম্ভব কমিয়ে আনা। অর্থাৎ, দীর্ঘ সুনির্দিষ্ট অপেরেশনের পরিবর্তে, যতটুকু রোগীর জীবন রক্ষার্থে প্রয়োজন, অপারেশন তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।
গ) অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র বাদে (ইমার্জেন্সি ডায়াগনস্টিক ল্যাপারোস্কপি) ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির ব্যবহার সীমিত রাখা।
ঘ) ক্যান্সার সার্জারিকে ইমার্জেন্সি সার্জারি হিসাবে গণ্য করা এবং প্রাধান্য দেয়া।
বিশেষ সতর্কতা: “লক ডাউনে” ঘোষিত ছুটির কারণে, অনেকের মধ্যে এধরণের একটা মানসিকতা কাজ করছে যে, তাদের এতদিনের পুষে রাখা রোগ (যেমন: বর্তমানে উপসর্গহীন পিত্তপাথর), যার অপারেশন এতো দিন সময়-ছুটির অভাবে তারা করতে পারেন নাই, তা তারা এই ছুটির অবকাশে করার তাগিদা বোধ করছেন। কিন্তু সাবধান! অহেতুক ঝুঁকি কেন নিবেন!!! যা আপনি পরবর্তী সময়ে তুলনামূলক ঝুঁকিমুক্ত অবস্থায় সহজে করতে পারবেন ।
ডাঃ ফারুকুজ্জামান
এফ সি পি এস (সার্জারি), এম এস ( সার্জারি ), এম আর সি এস (ইংল্যান্ড), এম সি পি এস (সার্জারি)
সহকারী রেজিস্ট্রার, সার্জারি বিভাগ
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল